Saturday, December 24, 2011

প্রতি-কবিতার জনককে অভিনন্দন

প্রতি-কবিতার জনককে অভিনন্দন

রাজু আলাউদ্দিন | তারিখ: ০৯-১২-২০১১

ক্রিস্তোবাল কোলনের ডিয়ারিও দে আ বোর্দো (ভ্রমণের দিনলিপি), আন্তোনিও পিগাফেত্তার প্রিমের বিরাহে আলরেদেদোর দেল মুন্দো (প্রথম বিশ্বভ্রমণ) কিংবা হেরোনিমো দে বিবারের ক্রোনিকল দে লস রেইনোস দে চিলে (চিলি রাজ্য সম্পর্কে ক্রনিকল)-এর মাধ্যমে যখন এক অজানা মহাদেশের অদ্ভুতুড়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হলো স্পেনিয়রা, তখন তাদের বিস্ময়ের কোনো সীমা ছিল না, কেননা এই অজানা মানচিত্রে যা কিছুই দেখা গেল তার সঙ্গে মিল ছিল না তাদের চেনা বাস্তবতার।
গোটা মহাদেশটাকেই স্পেনিয়দের কাছে মনে হয়েছিল এক মাতাল মানচিত্র। এমনই ছিল লাতিন আমেরিকা আবিষ্কারের আদিপুরুষদের প্রাথমিক অভিজ্ঞতা।
১৪৯২ সালে লাতিন আমেরিকা আবিষ্কারের পর থেকেই শাসকেরা এই মহাদেশ দখল ও লুটপাটের মাধ্যমে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিল ওই বাস্তবতাকে নির্মমভাবে। তারা শুরু করেছিল এই বাস্তবতাকে নিজেদের মতো গড়ে নিতে। অতএব, এবার বিস্ময়ের পালা লাতিন আমেরিকা শাসনকারীদেরই। কেননা, তারা এই বর্বরতায় হতবাক হয়ে পড়েছিল।

কয়েক শতকের স্তব্ধতা ভেদ করে সাহিত্যে প্রথম যে কণ্ঠটি বিস্ফোরিত হয়েছিল, তিনি চিলির মহান কবি পাবলো নেরুদা। গোটা লাতিন আমেরিকাবাসীর শোষণ-বঞ্চনা ও নির্মম বাস্তবতার পাশাপাশি তাদের আত্মার মহিমাকে এমনভাবে রূপদান করলেন তিনি, যা গোটা বিশ্বকে অভিভূত করে দিয়েছিল।
যে মহাদেশকে একদা পশ্চিম দখল করে নিয়েছিল বর্বরতার মাধ্যমে, সেই মহাদেশ গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে পাল্টা দখল শুরু করে দিয়েছিল বর্বরতার জবাবে তীব্র জীবনমুখিনতা, ভালোবাসা, শিল্প, গান আর সাহিত্যের মতো আরও টেকসই ধারালো ও অব্যর্থ অস্ত্রের মাধ্যমে। এই পাল্টা দখলে নেতৃত্ব দিয়েছিল চিলি, অন্তত কবিতার জায়গা থেকে তো বটেই। আর এতে কেবল নেরুদাই ছিলেন না, নেরুদার আগেও ছিলেন কেউ কেউ, যেমন—গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, বিসেন্তে উইদোব্রো, পাবলো দে রোকা, উমবের্ডো দিয়াস কাসানুয়েবা। আর নেরুদার পরে চিলিরই আরেক গুরুত্বপূর্ণ কবি নিকানোর পাররা।
যে বিপুল কল্পনাশক্তি, ইতিহাসচেতনা, আর গোটা জনগোষ্ঠীর যৌথ চেতনাকে অঙ্গীভূত করে নেরুদা হয়ে উঠেছিলেন আগ্নেয়গিরির মতো উদিগরণশীল এক কবি, তাঁকে এড়িয়ে স্প্যানিশ কবিতায় নতুন ধারা নির্মাণ পরবর্তী কবিদের জন্য ছিল এক দুঃসাধ্য কাজ। পাররা সেই দুঃসাধ্য কাজটি করেছিলেন নেরুদার জীবদ্দশাতেই। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও নেরুদার কবিতার সর্বগ্রাসী প্রবণতার গোপন দংশন থেকে সুরক্ষা করেছেন নিজেকে। এটা খুবই আশ্চর্যের যে চিলি ও আর্হেন্তিনায় গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে একাধিক সাহিত্যিক দল দেখা দিয়েছে কিন্তু এর কোনোটিই পাররাকে গণ্ডীভূত করে ফেলতে পারেনি। লুইস ওইয়ারসুন, হোর্হে মিইয়াস, আলবের্তো বায়েসা ফ্লোরেস, বেনানসিও লিসবোয়া এবং বিক্তোরিয়ানো বিকারিওকে নিয়ে যে দল গড়ে উঠেছিল, তাদের মধ্যে নিকানোর পাররা, নিজের মুদ্রাগুণে আলাদা হয়ে পড়েছিলেন প্রায় শুরু থেকেই।
পাররার প্রথম কবিতার বই কানসিওনেরো সিন নম্ব্রে বা বেনামি গানের খাতা বেরিয়েছিল ১৯৩৭ সালে। বিসেন্তে উইদোব্রো তখন খ্যাতি ও প্রতিপত্তির চূড়ায়। নেরুদাও তত দিনে পরিচিত। এঁদের প্রভাব এড়িয়ে সত্যিকারের নতুন ধরনের কবিতা লেখা ছিল প্রায় অসম্ভব। এঁদের লিরিক-স্বভাবের প্রভাব, আখ্যানধর্মিতা, এমনকি লোর্কার রোমান্সেরো হিতানে গ্রন্থের প্রভাবও এই বইয়ের মধ্যে পাওয়া যাবে।
কিন্তু আবার এই প্রথম বইটির মধ্যেই, পরবর্তী সময়ে তিনি যে প্রতি-কবিতা বা অ্যান্টি পোয়েমস-এর ধারণা নিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন, তার বীজও অতলে বুনে রেখেছিলেন। ১৯৫৪ সালে সেই বীজ পরিণত বৃক্ষ ও ফলে শোভিত হয়ে প্রকাশিত হয় পোয়েমাস ই আন্তিপোয়েমাস নামে। এই বইয়ে পাররা তাঁর চোখ-ধাঁধানো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।
পাবলো নেরুদার প্রভাবে ইতিমধ্যে যে কাব্যধারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, সেই ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এই গ্রন্থের কবিতাগুলো। ঠাট্টা-মশকরা, ব্যাজস্তুতি, আর প্রতিনায়কধর্মী চরিত্রের অস্তিত্ব—এই সব উপাদানের হুল্লোড় পাঠকদের মনোযোগকে সচকিত করে তুলেছিল। আর এর ভাষাও ছিল আগের কবিদের কাব্যিক ভাষার জবরদস্ত চর্চার বাইরে, বাইরে মানে একেবারে কথ্য ভাষার আদলকে অবলম্বন করেছিলেন পাররা। এর মধ্যে অঙ্গীভূত করে নিয়েছিলেন সংলাপ, দৈনন্দিন আপাততুচ্ছ বিষয়গুলোকেও, কিন্তু পাররার প্রতি-কাব্যিক স্পর্শে, তির্যক পর্যবেক্ষণে আর ঠাট্টায় সেগুলো তারা-বাত্তির মতো জ্বলে উঠেছিল। শিশুর কাছে খেলনা যেমন লোভনীয়, তেমনি তাঁর কবিতাকেও বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন বুদ্ধির দীপ্তি, হাস্যরস, উল্লাস আর নিরাবেগ অ্যাবসার্ডিটির মাধ্যমে।
তাঁর প্রতি-কবিতার ধারণা গোটা লাতিন আমেরিকায় কাব্যতত্ত্বের ধারায় যেমন নতুন, তেমনি তা গভীরভাবে প্রভাবসঞ্চারী হয়ে উঠেছিল। প্রভাবের প্রধান কারণ এর সম্মোহনী সারল্য। কিন্তু সারল্য ছিল বুদ্ধিমত্তা আর রসবোধের দ্বারা শাণিত। পাররার আগে স্প্যানিশ কবিতা নেরুদা বা উইদোব্রোর কাব্যিক আভিজাত্যের বাইরে যাওয়ার হিম্মত দেখাতে পেরেছে—এমন নজির প্রায় বিরল। যদিও ‘প্রতি-কবিতা’ শব্দবন্ধটি পাররা ব্যবহার করার আগে থেকেই ছিল। পেরুর কবি এনরিকে বুস্তামেন্তে বাইয়িরিয়ানের আন্তিপোয়েমাস শিরোনামে ১৯২৬ সালে একটি বই বেরিয়েছিল। কিন্তু পাররার প্রতি-কবিতাবিষয়ক কাব্যতত্ত্বের সঙ্গে এর মিল আছে খুব কমই। আরও একজনও এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন, চিলির উইদোব্রো তাঁর ১৯৩১ সালে প্রকাশিত আল্তাসোর কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে।
বলাই বাহুল্য, পাররার সঙ্গে শব্দের মিলটুকু ছাড়া আর কোনো মিলই তাতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। চিলির সুপরিচিত সাহিত্য সমালোচক হোসে মিগেল ইবানঞেস লানলোইস পাররার প্রতি-কবিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘পাঁচের দশকের প্রথম দিকে প্রতি-কবিতা যখন বিস্ফোরিত হলো, তখন পাররা আমাদের বিস্মৃতপ্রায় এই সচেতনতার কাছে নিয়ে গেল, “আবার! কবিতায় তাহলে সবই বলা যায়!’”
আসলেই তাই। আশ্চর্য জাদুবলে সবকিছুকেই তিনি কবিতার বিষয় করে তুলেছেন। প্রচলিত কাব্যিক ঐতিহ্যের বাইরে গিয়েই তিনি কবিতাকে জনগ্রাহী করে তুলেছেন। আর্হেন্তিনার লেখক ও সাহিত্য সমালোচক রিকার্দো পিগলিয়ার ভাষায়, ‘আমরা সবাই বিশ্বাস করি, চিলির সাহিত্য, প্রথম এবং মুখ্যত, আসলে চিলির কবিতাই: উইদোব্রো, নেরুদা...আর ওই মহৎ কবিদের গোটা ধাবার মধ্যে আমার কাছে যিনি অন্য সবার ওপরে, তিনি নিকানোর পাররা। (নিকানোর পাররা, অ্যান্টিপোয়েমস হাউ টু লুক বেটার অ্যান্ড ফিল গ্রেট, (অনুবাদক: লিজ ওয়ার্নার), নিউ ডিরেকশনস, ২০০৪, পৃ: ভূমিকাংশ - ১১)’

শুধু স্প্যানিশভাষী সমালোচকদের কাছেই নন, ইংরেজিভাষী সমালোচকদের কাছেও তিনি সমাদৃত হয়েছেন তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য। মার্কিন সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম মনে করেন, ‘অবশ্যই আমি বিশ্বাস করি, সাহিত্যের জন্য পাররার নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত...নিঃসন্দেহে তিনি পশ্চিমের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন (নিকানোর পাররা, অ্যান্টিপোয়েমস হাউ টু লুক বেটার অ্যান্ড ফিল গ্রেট, (অনুবাদক: লিজ ওয়ার্নার), নিউ ডিরেকশনস, ২০০৪, পৃ: ভূমিকাংশ - ১১)’
বলা হয়ে থাকে, নেরুদার শেষের দিকের কোনো কোনো কবিতায় রয়েছে এই অনুজের ছায়া। কী ভাবতেন এই অনুজ সম্পর্কে নেরুদা? স্পষ্টই যে নেরুদার বিরুদ্ধাচরণ করে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে দিলেন, তাঁকে তিনি কীভাবে নিয়েছেন? শেলডেন রোডম্যানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পাবলো নেরুদা পাররার কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘পাররা হচ্ছে আভিজাত্য আর জনপ্রিয়তার মিশ্রণ। এটা তাঁর ভাষাকে দিয়েছে দুর্দান্ত অভাবনীয়তা। সে আমাদের সবচেয়ে উদ্ভাবনাময় চিলীয় কবি। সে সাম্যবাদী না, তবে লাতিন আমেরিকার সব কবির মতোই বামপন্থী। (শেলডেন রোডম্যান, টাংস অব ফলেন অ্যানজেলস, নিউ ডিরেকশনস, ১৯৭৪, পৃ: ৭০)
বহু বছর ধরেই তিনি নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্য তালিকায় আছেন। নোবেল কমিটি কি এই পুরস্কারটি তাঁকে দেওয়ার মাধ্যমে নিজেরাই সম্মানটি অর্জন করার সুযোগ পাবে? প্রশ্নটা এ জন্য যে গত ৫ নভেম্বর ৯৬ বছর পূর্ণ হলো পারার। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক পাররা এখনো বেঁচে আছেন—এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য আনন্দের সংবাদ, কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে নোবেল কমিটি এখনো তাঁকে বিবেচনায় আনতে পারেনি।
তবে স্প্যানিশভাষী জগতের নোবেল পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত ‘সের্বান্তেস পুরস্কার’টি তিনি দেরিতে হলেও এ মাসের ১ তারিখে অর্জন করেছেন। এ জন্য জানাই অভিনন্দন। পাররা দীর্ঘজীবী হোন।


Source:http://www.prothom-alo.com


পাবলো নেরুদার কবিতা । কুকুরটি বেঁচে নেই

পাবলো নেরুদার কবিতা । কুকুরটি বেঁচে নেই

- শেখ নজরুল

কুকুরটি বেঁচে নেই

আমি তাকে বাগানের মাঝামাঝি কবর দিয়েছি
এখন আমাকে ভীষণ শক্তিহীন মনে হচ্ছে।
তার সাথে বহুদিন সঠিক পথেই হেঁটে গেছি
ঢেউখেলা চুলে যে হাঁটবে না আমার সাথে কোনদিন।
আমি বাস্তবাদী, আকাশের শূন্যতাকে বিশ্বাস করি না
জানি আমাদের মতো কারো জন্য কোন স্বর্গ নেই
তবে কুকুরটি স্বর্গবাসি হলে আমিই সুখি হবো বেশি
এবং জানি সে আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করবে
প্রভূত্ব দেখাবে লেজ নেড়ে একমাত্র বন্ধুর জন্য।
কুকুরটি কখনো দাসত্ব করেনি, জামার ওপর হাঁটেনি
আয়ত্বে নেবার জন্য সে কখনও ছোঁয়ায়নি চুমু
অন্যদের মতো যৌনতায় মাতেনি সে
সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো বন্ধু হয়ে
যতোটুকু প্রয়োজন, যতোটুকু দরকার
সে আমাকে বুঝতে চাইতো মানুষের প্রয়োজনে
মানুষ পারে না অথচ কুকুরটি পেরেছিল নষ্টপ্রহরে।
স্বপ্নের চেয়েও শুদ্ধ মনে হতো তার দু’চোখ
মিষ্টি এবং পশমি গন্ধময় সুন্দর দিনে
কাছাকাছি প্রশ্নহীন, আমি তার লেজ ছুঁয়ে-
সাগর সৈকতে হেঁটেছি বহুদিন
শীতে যেখানে পাখিরা নির্জন আকাশ ভরে রাখে
সেখানে আমার পশমি কুকুর সাগরে ঢেউয়ে লাফাতো
আশ্চর্য কুকুর মুহুর্তেই তার সোনারং লেজ নিয়ে
আবার দাঁড়াতো সাগরের সব জল নাড়তে।
আনন্দ! কি যে আনন্দ তার!
আমার কুকুর জেনেছিল সুখী হতে হয় কোন পথে
মানুষের লজ্জাহীন দৌরাত্বের শাসন উপেক্ষা করে।
সেই কুকুরের জন্য আজ কোন শোকবার্তা নেই
সে এখন বহুদুরে, আমি তাকে মাটি চাপা দিয়েছি
অথচ তার ভালোবাসা মাটি থেকে বের হয়ে আসছে
যা বহনের ক্ষমতা আজ আমারও নেই।


পাবলো নেরুদার কবিতা : প্রতীক ও উপমা

পাবলো নেরুদার কবিতা : প্রতীক ও উপমা

পৃথিবীর কালজয়ী কবিদের একজন পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩)। তিনি শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তা একইসঙ্গে অর্জন করেছিলেন। কোনো কবি জীবৎকালে তার মতো জনপ্রিয় কখনও হননি। তার কবিতার অন্যতম উপাদান প্রকৃতি। তিনি মানুষের আবেগ, প্রেম ও হতাশা প্রকাশে 'কবিতার জন্যে অনুপযোগী' তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুুনিচয়কে প্রতীক ও উপমা আকারে তার কবিতায় সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। অবশ্য তিনি নিজে এসব কথা স্বীকার করতে চাইতেন না। ১৯৭১ সালে দ্য প্যারিস রিভিয়্যুতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'আমি প্রতীকে বিশ্বাস করি না। এগুলো স্রেফ জাগতিক জিনিস। সমুদ্র, মাছ, পাখি আমার কাছে অস্তিত্ববান বস্তুতভাবেই। আমি এগুলোকে বিবেচনা করি দিনের আলোকে বিবেচনা করার মতো করেই। ... একটা ঘুঘু দেখলে তাকে আমি ঘুঘুই বলি। ঘুঘু, তা সেটা হাজির থাকুক আর না-ই থাকুক, আমার কাছে তার একটা আকার আছে, আত্মগতভাবেই হোক আর বিষয়গতভাবেই হোক, কিন্তু সেটা কখনও ঘুঘু ছাড়া আর কিছু বোঝায় না।' তার এই বক্তব্য সত্ত্বেও আমরা দেখি তার কবিতায় উপমা-প্রতীকের সযত্ন ও সচেতন ব্যবহার কীভাবে তার আবেগ ও উপলব্ধিকে শানিত ও প্রভাবশীল করে তোলে।
মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের এই একাকীত্বের যন্ত্রণা পাবলো নেরুদা সইতে পারেন না। এই কষ্টের তিনিও অংশীদার। তিনি প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে, এর যাবতীয় বস্তুনিচয়ের সঙ্গে, বরং এর অস্তিত্বের সঙ্গে, নিজেকে সংযুক্ত করতে চান, মিশ্রিত হয়ে থাকতে চান। কারণ তিনি মনে করেন প্রকৃতি শক্তি ও আধ্যাত্মিকতার আধার। তার কবিতায় এই বোধ ও আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে প্রকৃতি থেকে আহরিত উপমা ও প্রতীকের মাধ্যমে। নেরুদার রচনায় এ রকম চারটি উপমা_ মাটি, বাতাস, পানি এবং আগুন_ কীভাবে বিপরীতার্থকভাবে পাঠকমনে এই বিচ্ছিন্নতার দুঃখ চারিয়ে দেয় সেটা খতিয়ে দেখব। এই জিনিসগুলোর প্রত্যেকটি একক সমগ্রতাকে নির্দেশ করে, কিন্তু নেরুদার কবিতায় তা-ই হয়ে ওঠে বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্বের যন্ত্রণার প্রতীক।
মাটি
মাটি প্রকৃতির ভিত্তি, সম্ভবত সবচেয়ে বড় উপাদান। মাটি একাই প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এই মাটি নেরুদার কবিতায় এমন দুর্লভ বিশুদ্ধতার প্রতীক হয়ে ওঠে যার কাছে পেঁৗছানো যায় না। তার 'মাচ্চু পিচ্চুর পাহাড়' কবিতায় প্রতীক ও উপমা হিসেবে মাটির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। অ্যাডাম-ঈভের স্বর্গোদ্যানের মতো 'মানব বসন্ত'ও অপচয়িত হয়। নেরুদা মাটির উপমাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে উপস্থাপন করেন বটে, কিন্তু শেষ করেন এই সিদ্ধান্ত টেনে যে, মানবজীবন প্রকৃতির সঙ্গে মিলে যেতে পারে না। তার যন্ত্রণাও এখানে যে, তিনি মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায়ে জীবনদায়িনী মাটির মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে পারেন না।
বাতাস
মাটির মতো বাতাসও একটি একক, অবিভাজ্য ও অভেদ্য পূর্ণতা ও সমগ্রতা যা প্রকৃতিকে ব্যাপ্ত করে আছে। নেরুদার 'মাচ্চু পিচ্চুর পাহাড়' শুরু হয়েছে 'বাতাস থেকে বাতাসের দিকে' পঙ্ক্তি দিয়ে, তিনি এই শব্দগুচ্ছকে টেনে নিয়ে যান সেই একই পথে, যে পথে কথক বাতাসের মধ্য দিয়ে অর্থের সন্ধানে দিশেহারা হয়ে ছুটছে। বাতাস এখানে শূন্যতা, সে কথা বলে কবির নির্জনতার নীরব প্রকাশময়তার মতো। বাতাসের সর্বব্যাপক অর্থহীনতা কবিতাকে ব্যাপ্ত করে।
পানি
বাতাসের মতো পানিরও একই রকম দ্বৈত গুরুত্ব রয়েছে : সংযোগ সৃষ্টিতে পানির রয়েছে সর্বব্যাপক ক্ষমতা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে একটা অসম্ভব শূন্যতাকে উপস্থাপন করতে পারে এবং করেও। মাটি এবং বাতাসের মতো পানি প্রতীকেরও কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই, কিন্তু সে তরল এবং আবেগের ভার বহনে সক্ষম। 'বারকারোলা'য় নেরুদা 'সমুদ্রের চারপাশে' যোগাযোগের কল্পিত সম্ভাবনার কথা বলেছেন এবং 'শূন্য পানি'র প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। কবি যে নারীকে আহ্বান করেন সমুদ্র তার মতোই সুন্দর এবং শক্তিময় জীবনচেতনার আধার। পানির প্রচ তার বৈশিষ্ট্য কবিতার শেষ দিকে ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে, যখন নেরুদা 'লাল পানি' এবং 'ফেনা এবং রক্ত'র উপমা হাজির করেন। তার অনুভূতি 'লাল পানি'র মতোই অশান্ত, তীরে আছড়ে পড়া ফেনিল সমুদ্র-তরঙ্গ এবং রক্তের মধ্যে ভাসমান। পানি হচ্ছে প্রতীকী জীবনশক্তি যা কবিতার মধ্য দিয়ে আশাকে যন্ত্রণার দিকে টেনে নিয়ে যায়। তিনি তার দয়িতা বা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হতে পারেন না_ তার আকাঙ্ক্ষা একইসঙ্গে দৈহিক এবং আত্মিক। নেরুদা শেষ করেন এই বলে_ 'সমুদ্র একাকী'। পানি হচ্ছে নিঃসঙ্গ মানুষের নির্জনতার মতো_ কবির অবস্থাও একইরকম, তিনি তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না।
আগুন
নেরুদা আগুনের প্রতীক ব্যবহার করেছেন প্রেমের শক্তি এবং নৈঃসঙ্গ্যের দহন-ক্ষমতা বোঝানোর জন্য। আবার ওই 'বারকারোলা' কবিতাটির কথাই ধরা যাক। এর এক জায়গায় কবি বলছেন_ 'আকাশটাকে পুড়িয়ে চলেছে বাষ্পায়িত অগি্নশিখার কোলাহল।' আর্দ্র অগি্নশিখা প্রবল শক্তিমান এবং ক্রোধপূর্ণ, কিন্তু একইসঙ্গে কোলাহলময় এবং দ্রুতসঞ্চারীও। অগি্নশিখা সত্যকে প্রজ্বলিত করে, তা যতই যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন এবং তাকে পুড়িয়ে কবিতায় পরিণত করে।
চার উপমা
নেরুদা এই চারটি জিনিসকে উপমা ও প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতার দুঃখকে তীব্রতর করে তুলতে; তাছাড়া তিনি শব্দের মধ্য দিয়ে অস্তিত্বের তথাকথিত আদিম সারবস্তুর দিকে ধাবিত হন। তিনি প্রকৃতির অন্তর্নিহিত অর্থ ও তাৎপর্যকে স্বীকার করেন এবং কবিতার মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয় সুখভোগের মনোভাব নিয়ে সমগ্রতার কাছে পেঁৗছার কঠোর চেষ্টা করেন। মাটি, বাতাস, আগুন এবং পানি আমাদের পার্থিব ও ইন্দ্রিয়জ অস্তিত্বের ভিত্তি_ এদেরও ভাবাবেগ আছে এবং এরা শক্তিমান, তবুও এই শক্তিগুলো দুর্ভোগের উৎস। কারণ মানুষ তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। নেরুদা পৃথিবীর এই চারটি উপাদানকে ব্যাখ্যা ও সম্প্রসারিত করেছেন সমগ্রতা ও নিঃসঙ্গতা, ভালোবাসা ও দুঃখ, আশা ও নৈরাশ্যের নিরিখে। তার কাব্যভাষা এমন একটা জীবন-চেতনাকে ধারণ করে, যা আদিম প্রতীক ও ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে ভিত্তি করে বেগবান, সে কারণে প্রকৃতি থেকে আমাদের দুঃখজনক বিচ্ছিন্নতা সৃজনশীল চিন্তাকে উৎসাহিত করে। এভাবে কবির বিষয় ও প্রকরণ, জীবনাভিজ্ঞতা ও চেতনা এবং চিন্তা ও সৃজনশীলতা একই সূত্রে আবদ্ধ থাকে।

না. ও

পাবলো নেরুদার কবিতা

পাবলো নেরুদার কবিতা

রবি, ২৫ ডিসেম্বর ২০১১, ১১ পৌষ ১৪১৮

খালেদ হোসাইন অনূদিত

চিলির এক সাধারণ শ্রমিক পরিবারে জন্ম পাবলো নেরুদার (১৯০৪—১৯৭৩)। কবি হিসেবে বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি সকল ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে নির্ভীক কলম-চালনার জন্য। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় তাঁর হূদয়াবেগের প্রাবল্য ও তীব্রতা যেন রক্তে-জোয়ার বইয়ে দেয়। তাঁর জীবন-পরিসরে ঝড়-তোলা নানা সাহিত্যিক মতবাদের চিহ্ন বিভিন্ন কবিতায় নানাভাবে পাওয়া যায়—রোম্যান্টিসিজম বা রিয়ালিজম বা সুরিয়ালিজম ইত্যাদি—কিন্তু সবই তাঁর শিল্প-মানসতা ও সৃষ্টির অনুবর্তী। কবিতাও লিখেছেন নানা ধরনের। পরাবাস্তব কবিতার কাছাকাছি পাওয়া যায় ঐতিহাসিক মহাকাব্য, যৌনতাকে আড়াল না-করা হূত্খননময় প্রেমের কবিতা। ফ্যাসিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বা নির্যাতিত মনুষ্য-প্রধান সহানুভূতিময় কবিতায় যেমন এর চিহ্ন স্পষ্ট, গভীর ব্যক্তিক অনুভূতিময় প্রেমের কবিতায়ও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য, প্রকট। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত কুড়িটি প্রেমের কবিতা এবং একটি বিষণ্নতার গান (Twenty Poems of Love and a Song of Despair). এর আগে, ১৯২১ সালে বেরিয়েছে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ক্রেপাকুলারিও’।

একটি মহাদেশের স্বপ্নকে কবিতায় রূপায়ণের জন্য নেরুদা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭১ সালে। লোরকা বলেছিলেন রুবেন দারিওর পরে পাবলো নেরুদাই আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কবি।

আঁকড়ে থাকা হূদয়

পাবলো নেরুদা


আমরা হারিয়ে ফেলেছি, এমন-কি, সান্ধ্য-আলোর উত্থান

হাতে হাত রেখে আমরা সেই সন্ধ্যায় ছিলাম

সকলের দৃষ্টির আড়ালে—

তারপর পৃথিবীতে নেমে এল নীল এক রাত।

আমার জানালা থেকে দেখতে পেলাম

দূর পাহাড়ের মাথায় সূর্যাস্তের মহোত্সব।

মাঝেমধ্যে সূর্যের একটি টুকরো

ধাতব-মুদ্রার মতো

জ্বলে উঠত আমার মুঠোয়।

আমার সমুদয় যন্ত্রণায়

একাকার হয়ে যাওয়া আত্মার সর্বাংশ দিয়ে

আমি স্মরণ করতাম তোমাকে।

তখন তুমি কোথায়?

আর কে ছিল সেখানে তোমার সঙ্গে?

কী বলছিল সে?

কেন আমার অন্তরে উদ্ভূত হল

ব্রহ্মাণ্ড-পরিব্যাপ্ত ভালোবাসা,

যখন আমি নিমজ্জিত পরম দুঃখে

আর উপলব্ধি করছিলাম

তুমি আছ অনেক দূরে?

সেই শাস্ত্র সব সময় সান্ধ্য-আলোয় মুখ থুবড়ে পড়ে

আর আমার নীল সোয়েটার

আহত কুকুরের মতো

পায়ের তলে গড়াগড়ি যায়।

সব সময়, সদাসর্বদা, তুমি পিছিয়ে গিয়েছ

দিন-রাত্রির সন্ধিক্ষণে

সেই আলোর আবিষ্টতায়—

যা মুছে ফেলে সমুদয় মূর্তির অবয়ব।

সবচেয়ে দুঃখী কবিতা

আমি আজ সারারাত লিখতে পারি

সবচেয়ে দুঃখের কবিতা।

লিখতে পারি তাত্ক্ষণিকভাবে :

“তারাভরা এই রাত,

আর তারাগুলো নীল—

দূরত্বের আবেগে কম্পমান।”

রাতের বাতাস ঘুরপাক খাচ্ছে

আকাশে। আর সঙ্গীতে।

আজ সারারাত আমি লিখতে পারি

সবচেয়ে দুঃখের কবিতা।

আমি তাকে ভালোবাসতাম এবং

মাঝেমধ্যে সে-ও আমাকে।

এমন রজনীতে আমি তাকে জড়িয়ে রাখতাম

আমার বাহুতে। অপরিসীম আকাশের নিচে

আমি তাকে অসংখ্যবার চুম্বন করতাম।

আমি তাকে ভালোবাসতাম এবং মাঝেমধ্যে

সে-ও আমাকে। তার বড় ও অচঞ্চল চোখকে

কেমন করে ভালো না-বেসে পারা যায়?

আমি আজ সারারাত লিখতে পারি

সবচেয়ে দুঃখের কবিতা।

আমার চিন্তনের সীমানায় সে ছিল না।

আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি

অনুভবের প্রগাঢ়তায়।

তার কণ্ঠ শোনার প্রতীক্ষায়

বিশাল রাত্রি হয়ে উঠত অন্তহীন।

আত্মায় কবিতা আবির্ভূত হয় —

যেভাবে ঘাসের ডগায়

জমে ওঠে ভোরের শিশির।

কী এমন এসে যায় এতে যে, আমার ভালোবাসা

তাকে চিরদিনের জন্য ধরে রাখতে পারেনি

ঘনিষ্ঠতম আলিঙ্গনে? তারাভরা এই রাত

আর সে আমার সঙ্গে নেই।

এই পর্যন্তই। আর কিছু নয়।

দূরে — কেউ গান গায়। দূ-রে।

তাকে না-পেয়ে আমার আত্মা

হয়ে গেছে সর্বস্বান্ত।

ঘনিষ্ঠতম নৈকট্যে নিয়ে আসবার জন্য,

আমার দুই চোখ

তাকে খুঁজে ফেরে নিরন্তর।

আমার হূদয় তাকে খুঁজে ফেরে

কিন্তু সে আমার সঙ্গে নেই।

আগের মতোই এই রাত,

আগের মতোই এই রাত সবকিছুকে

জোছনা-ধবল করে তোলে —

আর আমরা, সে আর আমি মিলে

আমরাই ছিলাম,

এখন আর আমরা নেই।

এখন আর তাকে আমি ভালোবাসি না। সত্যি!

কিন্তু কি দুর্দান্ত ভালোই না তাকে বাসতাম একদা!

আর আমার কণ্ঠস্বর আজও খুঁজে ফেরে

তেমন বাতাস—যা স্পর্শ করতে পারবে তার শ্রবণেন্দ্রিয়।

আর কেউ। সে হবে অন্য কেউ। যেমন একসময়

সে-ই ছিল আমার সকল চুম্বনের

অদ্বিতীয় স্বত্বাধিকারী।

তার কণ্ঠস্বর, তার হালকা-পাতলা শরীর।

তার অতল দৃষ্টি।

এখন আমি আর তাকে ভালোবাসি না। সত্যি।

তবু কখনো কখনো মনে হয়,

তাকেই আমি ভালোবাসি।

ভালোবাসা এত সূক্ষ্ম — আর ঔদাস্য এত প্রলম্বিত।

কেননা, এরকম রাতগুলোতে এখনো তাকে আমি

আমার বাহুতেই জড়িয়ে রাখি,

তার অভাবে আমার আত্মা হয়ে পড়ে অস্তিত্বহীন।

এ-ই হয়তো আমাকে দেয়া তার শেষ বেদনা, আর

এটাই হয়তো তাকে নিয়ে লেখা আমার অন্তিম কবিতা।

Source: www.ittefaq.com.bd