Saturday, December 24, 2011

পাবলো নেরুদার কবিতা

পাবলো নেরুদার কবিতা

রবি, ২৫ ডিসেম্বর ২০১১, ১১ পৌষ ১৪১৮

খালেদ হোসাইন অনূদিত

চিলির এক সাধারণ শ্রমিক পরিবারে জন্ম পাবলো নেরুদার (১৯০৪—১৯৭৩)। কবি হিসেবে বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি সকল ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে নির্ভীক কলম-চালনার জন্য। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় তাঁর হূদয়াবেগের প্রাবল্য ও তীব্রতা যেন রক্তে-জোয়ার বইয়ে দেয়। তাঁর জীবন-পরিসরে ঝড়-তোলা নানা সাহিত্যিক মতবাদের চিহ্ন বিভিন্ন কবিতায় নানাভাবে পাওয়া যায়—রোম্যান্টিসিজম বা রিয়ালিজম বা সুরিয়ালিজম ইত্যাদি—কিন্তু সবই তাঁর শিল্প-মানসতা ও সৃষ্টির অনুবর্তী। কবিতাও লিখেছেন নানা ধরনের। পরাবাস্তব কবিতার কাছাকাছি পাওয়া যায় ঐতিহাসিক মহাকাব্য, যৌনতাকে আড়াল না-করা হূত্খননময় প্রেমের কবিতা। ফ্যাসিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বা নির্যাতিত মনুষ্য-প্রধান সহানুভূতিময় কবিতায় যেমন এর চিহ্ন স্পষ্ট, গভীর ব্যক্তিক অনুভূতিময় প্রেমের কবিতায়ও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য, প্রকট। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত কুড়িটি প্রেমের কবিতা এবং একটি বিষণ্নতার গান (Twenty Poems of Love and a Song of Despair). এর আগে, ১৯২১ সালে বেরিয়েছে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ক্রেপাকুলারিও’।

একটি মহাদেশের স্বপ্নকে কবিতায় রূপায়ণের জন্য নেরুদা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭১ সালে। লোরকা বলেছিলেন রুবেন দারিওর পরে পাবলো নেরুদাই আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কবি।

আঁকড়ে থাকা হূদয়

পাবলো নেরুদা


আমরা হারিয়ে ফেলেছি, এমন-কি, সান্ধ্য-আলোর উত্থান

হাতে হাত রেখে আমরা সেই সন্ধ্যায় ছিলাম

সকলের দৃষ্টির আড়ালে—

তারপর পৃথিবীতে নেমে এল নীল এক রাত।

আমার জানালা থেকে দেখতে পেলাম

দূর পাহাড়ের মাথায় সূর্যাস্তের মহোত্সব।

মাঝেমধ্যে সূর্যের একটি টুকরো

ধাতব-মুদ্রার মতো

জ্বলে উঠত আমার মুঠোয়।

আমার সমুদয় যন্ত্রণায়

একাকার হয়ে যাওয়া আত্মার সর্বাংশ দিয়ে

আমি স্মরণ করতাম তোমাকে।

তখন তুমি কোথায়?

আর কে ছিল সেখানে তোমার সঙ্গে?

কী বলছিল সে?

কেন আমার অন্তরে উদ্ভূত হল

ব্রহ্মাণ্ড-পরিব্যাপ্ত ভালোবাসা,

যখন আমি নিমজ্জিত পরম দুঃখে

আর উপলব্ধি করছিলাম

তুমি আছ অনেক দূরে?

সেই শাস্ত্র সব সময় সান্ধ্য-আলোয় মুখ থুবড়ে পড়ে

আর আমার নীল সোয়েটার

আহত কুকুরের মতো

পায়ের তলে গড়াগড়ি যায়।

সব সময়, সদাসর্বদা, তুমি পিছিয়ে গিয়েছ

দিন-রাত্রির সন্ধিক্ষণে

সেই আলোর আবিষ্টতায়—

যা মুছে ফেলে সমুদয় মূর্তির অবয়ব।

সবচেয়ে দুঃখী কবিতা

আমি আজ সারারাত লিখতে পারি

সবচেয়ে দুঃখের কবিতা।

লিখতে পারি তাত্ক্ষণিকভাবে :

“তারাভরা এই রাত,

আর তারাগুলো নীল—

দূরত্বের আবেগে কম্পমান।”

রাতের বাতাস ঘুরপাক খাচ্ছে

আকাশে। আর সঙ্গীতে।

আজ সারারাত আমি লিখতে পারি

সবচেয়ে দুঃখের কবিতা।

আমি তাকে ভালোবাসতাম এবং

মাঝেমধ্যে সে-ও আমাকে।

এমন রজনীতে আমি তাকে জড়িয়ে রাখতাম

আমার বাহুতে। অপরিসীম আকাশের নিচে

আমি তাকে অসংখ্যবার চুম্বন করতাম।

আমি তাকে ভালোবাসতাম এবং মাঝেমধ্যে

সে-ও আমাকে। তার বড় ও অচঞ্চল চোখকে

কেমন করে ভালো না-বেসে পারা যায়?

আমি আজ সারারাত লিখতে পারি

সবচেয়ে দুঃখের কবিতা।

আমার চিন্তনের সীমানায় সে ছিল না।

আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি

অনুভবের প্রগাঢ়তায়।

তার কণ্ঠ শোনার প্রতীক্ষায়

বিশাল রাত্রি হয়ে উঠত অন্তহীন।

আত্মায় কবিতা আবির্ভূত হয় —

যেভাবে ঘাসের ডগায়

জমে ওঠে ভোরের শিশির।

কী এমন এসে যায় এতে যে, আমার ভালোবাসা

তাকে চিরদিনের জন্য ধরে রাখতে পারেনি

ঘনিষ্ঠতম আলিঙ্গনে? তারাভরা এই রাত

আর সে আমার সঙ্গে নেই।

এই পর্যন্তই। আর কিছু নয়।

দূরে — কেউ গান গায়। দূ-রে।

তাকে না-পেয়ে আমার আত্মা

হয়ে গেছে সর্বস্বান্ত।

ঘনিষ্ঠতম নৈকট্যে নিয়ে আসবার জন্য,

আমার দুই চোখ

তাকে খুঁজে ফেরে নিরন্তর।

আমার হূদয় তাকে খুঁজে ফেরে

কিন্তু সে আমার সঙ্গে নেই।

আগের মতোই এই রাত,

আগের মতোই এই রাত সবকিছুকে

জোছনা-ধবল করে তোলে —

আর আমরা, সে আর আমি মিলে

আমরাই ছিলাম,

এখন আর আমরা নেই।

এখন আর তাকে আমি ভালোবাসি না। সত্যি!

কিন্তু কি দুর্দান্ত ভালোই না তাকে বাসতাম একদা!

আর আমার কণ্ঠস্বর আজও খুঁজে ফেরে

তেমন বাতাস—যা স্পর্শ করতে পারবে তার শ্রবণেন্দ্রিয়।

আর কেউ। সে হবে অন্য কেউ। যেমন একসময়

সে-ই ছিল আমার সকল চুম্বনের

অদ্বিতীয় স্বত্বাধিকারী।

তার কণ্ঠস্বর, তার হালকা-পাতলা শরীর।

তার অতল দৃষ্টি।

এখন আমি আর তাকে ভালোবাসি না। সত্যি।

তবু কখনো কখনো মনে হয়,

তাকেই আমি ভালোবাসি।

ভালোবাসা এত সূক্ষ্ম — আর ঔদাস্য এত প্রলম্বিত।

কেননা, এরকম রাতগুলোতে এখনো তাকে আমি

আমার বাহুতেই জড়িয়ে রাখি,

তার অভাবে আমার আত্মা হয়ে পড়ে অস্তিত্বহীন।

এ-ই হয়তো আমাকে দেয়া তার শেষ বেদনা, আর

এটাই হয়তো তাকে নিয়ে লেখা আমার অন্তিম কবিতা।

Source: www.ittefaq.com.bd

No comments:

Post a Comment