Saturday, December 24, 2011

পাবলো নেরুদার কবিতা : প্রতীক ও উপমা

পাবলো নেরুদার কবিতা : প্রতীক ও উপমা

পৃথিবীর কালজয়ী কবিদের একজন পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩)। তিনি শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তা একইসঙ্গে অর্জন করেছিলেন। কোনো কবি জীবৎকালে তার মতো জনপ্রিয় কখনও হননি। তার কবিতার অন্যতম উপাদান প্রকৃতি। তিনি মানুষের আবেগ, প্রেম ও হতাশা প্রকাশে 'কবিতার জন্যে অনুপযোগী' তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুুনিচয়কে প্রতীক ও উপমা আকারে তার কবিতায় সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। অবশ্য তিনি নিজে এসব কথা স্বীকার করতে চাইতেন না। ১৯৭১ সালে দ্য প্যারিস রিভিয়্যুতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'আমি প্রতীকে বিশ্বাস করি না। এগুলো স্রেফ জাগতিক জিনিস। সমুদ্র, মাছ, পাখি আমার কাছে অস্তিত্ববান বস্তুতভাবেই। আমি এগুলোকে বিবেচনা করি দিনের আলোকে বিবেচনা করার মতো করেই। ... একটা ঘুঘু দেখলে তাকে আমি ঘুঘুই বলি। ঘুঘু, তা সেটা হাজির থাকুক আর না-ই থাকুক, আমার কাছে তার একটা আকার আছে, আত্মগতভাবেই হোক আর বিষয়গতভাবেই হোক, কিন্তু সেটা কখনও ঘুঘু ছাড়া আর কিছু বোঝায় না।' তার এই বক্তব্য সত্ত্বেও আমরা দেখি তার কবিতায় উপমা-প্রতীকের সযত্ন ও সচেতন ব্যবহার কীভাবে তার আবেগ ও উপলব্ধিকে শানিত ও প্রভাবশীল করে তোলে।
মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের এই একাকীত্বের যন্ত্রণা পাবলো নেরুদা সইতে পারেন না। এই কষ্টের তিনিও অংশীদার। তিনি প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে, এর যাবতীয় বস্তুনিচয়ের সঙ্গে, বরং এর অস্তিত্বের সঙ্গে, নিজেকে সংযুক্ত করতে চান, মিশ্রিত হয়ে থাকতে চান। কারণ তিনি মনে করেন প্রকৃতি শক্তি ও আধ্যাত্মিকতার আধার। তার কবিতায় এই বোধ ও আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে প্রকৃতি থেকে আহরিত উপমা ও প্রতীকের মাধ্যমে। নেরুদার রচনায় এ রকম চারটি উপমা_ মাটি, বাতাস, পানি এবং আগুন_ কীভাবে বিপরীতার্থকভাবে পাঠকমনে এই বিচ্ছিন্নতার দুঃখ চারিয়ে দেয় সেটা খতিয়ে দেখব। এই জিনিসগুলোর প্রত্যেকটি একক সমগ্রতাকে নির্দেশ করে, কিন্তু নেরুদার কবিতায় তা-ই হয়ে ওঠে বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্বের যন্ত্রণার প্রতীক।
মাটি
মাটি প্রকৃতির ভিত্তি, সম্ভবত সবচেয়ে বড় উপাদান। মাটি একাই প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এই মাটি নেরুদার কবিতায় এমন দুর্লভ বিশুদ্ধতার প্রতীক হয়ে ওঠে যার কাছে পেঁৗছানো যায় না। তার 'মাচ্চু পিচ্চুর পাহাড়' কবিতায় প্রতীক ও উপমা হিসেবে মাটির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। অ্যাডাম-ঈভের স্বর্গোদ্যানের মতো 'মানব বসন্ত'ও অপচয়িত হয়। নেরুদা মাটির উপমাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে উপস্থাপন করেন বটে, কিন্তু শেষ করেন এই সিদ্ধান্ত টেনে যে, মানবজীবন প্রকৃতির সঙ্গে মিলে যেতে পারে না। তার যন্ত্রণাও এখানে যে, তিনি মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায়ে জীবনদায়িনী মাটির মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে পারেন না।
বাতাস
মাটির মতো বাতাসও একটি একক, অবিভাজ্য ও অভেদ্য পূর্ণতা ও সমগ্রতা যা প্রকৃতিকে ব্যাপ্ত করে আছে। নেরুদার 'মাচ্চু পিচ্চুর পাহাড়' শুরু হয়েছে 'বাতাস থেকে বাতাসের দিকে' পঙ্ক্তি দিয়ে, তিনি এই শব্দগুচ্ছকে টেনে নিয়ে যান সেই একই পথে, যে পথে কথক বাতাসের মধ্য দিয়ে অর্থের সন্ধানে দিশেহারা হয়ে ছুটছে। বাতাস এখানে শূন্যতা, সে কথা বলে কবির নির্জনতার নীরব প্রকাশময়তার মতো। বাতাসের সর্বব্যাপক অর্থহীনতা কবিতাকে ব্যাপ্ত করে।
পানি
বাতাসের মতো পানিরও একই রকম দ্বৈত গুরুত্ব রয়েছে : সংযোগ সৃষ্টিতে পানির রয়েছে সর্বব্যাপক ক্ষমতা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে একটা অসম্ভব শূন্যতাকে উপস্থাপন করতে পারে এবং করেও। মাটি এবং বাতাসের মতো পানি প্রতীকেরও কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই, কিন্তু সে তরল এবং আবেগের ভার বহনে সক্ষম। 'বারকারোলা'য় নেরুদা 'সমুদ্রের চারপাশে' যোগাযোগের কল্পিত সম্ভাবনার কথা বলেছেন এবং 'শূন্য পানি'র প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। কবি যে নারীকে আহ্বান করেন সমুদ্র তার মতোই সুন্দর এবং শক্তিময় জীবনচেতনার আধার। পানির প্রচ তার বৈশিষ্ট্য কবিতার শেষ দিকে ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে, যখন নেরুদা 'লাল পানি' এবং 'ফেনা এবং রক্ত'র উপমা হাজির করেন। তার অনুভূতি 'লাল পানি'র মতোই অশান্ত, তীরে আছড়ে পড়া ফেনিল সমুদ্র-তরঙ্গ এবং রক্তের মধ্যে ভাসমান। পানি হচ্ছে প্রতীকী জীবনশক্তি যা কবিতার মধ্য দিয়ে আশাকে যন্ত্রণার দিকে টেনে নিয়ে যায়। তিনি তার দয়িতা বা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হতে পারেন না_ তার আকাঙ্ক্ষা একইসঙ্গে দৈহিক এবং আত্মিক। নেরুদা শেষ করেন এই বলে_ 'সমুদ্র একাকী'। পানি হচ্ছে নিঃসঙ্গ মানুষের নির্জনতার মতো_ কবির অবস্থাও একইরকম, তিনি তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না।
আগুন
নেরুদা আগুনের প্রতীক ব্যবহার করেছেন প্রেমের শক্তি এবং নৈঃসঙ্গ্যের দহন-ক্ষমতা বোঝানোর জন্য। আবার ওই 'বারকারোলা' কবিতাটির কথাই ধরা যাক। এর এক জায়গায় কবি বলছেন_ 'আকাশটাকে পুড়িয়ে চলেছে বাষ্পায়িত অগি্নশিখার কোলাহল।' আর্দ্র অগি্নশিখা প্রবল শক্তিমান এবং ক্রোধপূর্ণ, কিন্তু একইসঙ্গে কোলাহলময় এবং দ্রুতসঞ্চারীও। অগি্নশিখা সত্যকে প্রজ্বলিত করে, তা যতই যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন এবং তাকে পুড়িয়ে কবিতায় পরিণত করে।
চার উপমা
নেরুদা এই চারটি জিনিসকে উপমা ও প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতার দুঃখকে তীব্রতর করে তুলতে; তাছাড়া তিনি শব্দের মধ্য দিয়ে অস্তিত্বের তথাকথিত আদিম সারবস্তুর দিকে ধাবিত হন। তিনি প্রকৃতির অন্তর্নিহিত অর্থ ও তাৎপর্যকে স্বীকার করেন এবং কবিতার মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয় সুখভোগের মনোভাব নিয়ে সমগ্রতার কাছে পেঁৗছার কঠোর চেষ্টা করেন। মাটি, বাতাস, আগুন এবং পানি আমাদের পার্থিব ও ইন্দ্রিয়জ অস্তিত্বের ভিত্তি_ এদেরও ভাবাবেগ আছে এবং এরা শক্তিমান, তবুও এই শক্তিগুলো দুর্ভোগের উৎস। কারণ মানুষ তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। নেরুদা পৃথিবীর এই চারটি উপাদানকে ব্যাখ্যা ও সম্প্রসারিত করেছেন সমগ্রতা ও নিঃসঙ্গতা, ভালোবাসা ও দুঃখ, আশা ও নৈরাশ্যের নিরিখে। তার কাব্যভাষা এমন একটা জীবন-চেতনাকে ধারণ করে, যা আদিম প্রতীক ও ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে ভিত্তি করে বেগবান, সে কারণে প্রকৃতি থেকে আমাদের দুঃখজনক বিচ্ছিন্নতা সৃজনশীল চিন্তাকে উৎসাহিত করে। এভাবে কবির বিষয় ও প্রকরণ, জীবনাভিজ্ঞতা ও চেতনা এবং চিন্তা ও সৃজনশীলতা একই সূত্রে আবদ্ধ থাকে।

না. ও

No comments:

Post a Comment